0 comments gautam

 

দুপুর দুটো’র চড়া রোদ্দূর মাথার ওপর। কাঁটা ঝোপে হাত পা ছড়ে গেছে। তেষ্টায় ছাতি ফাটছে। বোতলের শেষ জলটুকু ভয়ে খেতে পারছি না। কারন সামনে কখন জল পাবো তা জানি না।ভাবছেন আমি আরেকটা চাঁদের পাহাড় লিখতে বসেছি। আমার সেই দুঃসাহস নেই। সবাই তো কমলেশ্বরবাবু নয়।

 

 

শুরু থেকে বলি, বাড়ির পাশে অ্যাডভেঞ্চার করব বলে মাঠাবুরু ক্যাম্প থেকে অযোধ্যা আপার ড্যাম যাবার একটা জঙ্গলের রাস্তা খুঁজতে শুরু করি। গুগুল আর্থ আর সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ম্যাপ দেখে একটা রাস্তা ঠিক হয়। মাঠাবুরু থেকে প্রথম দিন ডাউরি খাল, দ্বিতীয় দিন অযোধ্যা ড্যাম।পুরোটাই প্রায় জঙ্গলের রাস্তা। ম্যাপ আর কম্প্যাস দিয়ে রাস্তা মাপতে হবে।

 

 

মাঠাবুরুতে বন্ধুর তৈরি নতুন রিসর্ট, মালগুড়ি’তে একরাত হুল্লোড় করে কাটিয়ে পরেরদিন খুব সকালে হাঁটা শুরু মাঠাবুরু কল’এর দিকে। এটি খুব পরিচিত রাস্তা, মাঠাবুরু ক্যাম্পের লোকজন আর হাতি দু’দলেরই। সারা রাস্তাতে ডিমার্কেশান হিসাবে প্রচুর হস্তী বিষ্ঠা। পলাশের সময় হলেও এই পাহাড়ে তেমন পলাশ চোখে পড়েনা। ঘড়ির হিসাবে ঘন্টা খানেকের মধ্যে মাঠা কল’এ উঠে এলাম। এরপরের রাস্তা নিজেদের খুঁজে নিতে হবে। পকেট থেকে গুগুল আর্থ এর প্রিন্ট বের হল, কম্প্যাস ফেলে দিক ঠিক করে জঙ্গল ভেঙ্গে এগিয়ে চলা। মাঠাবুরু’এর নর্থে কুকুবুরু, আমরা এখন এই রেঞ্জটা পার করব। একটা ডিপ্রেশান পয়েন্ট ঠিক করে সেদিকে উঠতে লাগলাম। খুব একটা কষ্ট না করেই রেঞ্জটা পার হয়ে একটা বিশাল পাথরের এলাকাতে নেমে এলাম। পেছনে ফিরে দেখলে নিজেরই অবাক লাগছে কোথা দিয়ে নামলাম দেখে। আমি খুঁজে পাঁচ্ছিলাম না পয়েন্টটা। অমিয় দেখিয়ে দিল জায়গাটা। একটা মাত্র লাল রঙের কুসুম গাছ দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। আরেকটু নেমে আসতেই দেখলাম একটা পুকুর এর পাশে তিনটে পলাশ গাছ রক্তরাঙ্গা হয়ে আছে। সকাল থেকে একটানা হেঁটে আসা হয়েছে। কেউ কোন কথা না বলে লাল কার্পেটের ওপর নিজেদের বিছিয়ে দিলাম। বিস্কিট আর হরলিক্স দিয়ে লাঞ্চ সারা হল। আগুনের মতো পলাশ গাছগুলো জ্বলছে মনে হচ্ছে। বেশি সময় তাকিয়ে থাকলে কেমন একটা নেশা লাগছে। সুতরাং আবার স্যাক পিঠে তুলে নেওয়া। সামনের রাস্তা আরো কত তা জানা নেই। আমরা পাহাড় ছেড়ে সমতল জঙ্গলের মধ্যে চলতে শুরু করলাম। ফলে সামনে কোন টার্গেট ঠিক করতে পারলাম না আর রাস্তা হারালাম।

 

 

 

 

ফল স্বরূপ ওই ভোগান্তি। আমদের ম্যাপ বলছে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে তার নর্থ ইস্ট’এর পাহাড়ের মধ্যে ডাউরি খাল। ভেবেছিলাম জঙ্গল দিয়ে সোজা যাব। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি সামনে অনেকগুলো খাদ। পার হয়ে ওদিকে যাওয়ার উপায় নেই।

 

 

কিছুটা আগে আমরা একটা পায়ে চলা রাস্তা ছেড়ে এসেছি। ওই রাস্তাটা ধরলে আমরা পাহাড় থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলাম। তাই রাস্তা ছেড়ে জঙ্গল ধরেছিলাম। তাতে বিপদ বাড়ল। রাজা চাইছিল ওই পায়ে চলা রাস্তাতে ফিরে যেতে। সেই রাস্তা কোন গ্রামে নিয়ে গেলে সেখান থেকে আমরা সঠিক পথ পাবো। আমি আর অমিয়, তাতেই সহমত দিলাম।

 

 

ওই রাস্তা ধরে আমরা এলাম একরা গ্রামে। লোকের থেকে রাস্তা জেনে, এক বিশাল শালের জঙ্গল দিয়ে পৌঁছালাম কুদনা গ্রামে। দু চোখ জুড়িয়ে গেল গ্রামে ঢুকে। মাঠে কোথাও সোনা রঙের পাকা সর্ষে, তো কোথাও পান্না সবুজ ফসলের ক্ষেত। মাঝে মাঝে আগুন রাঙ্গা পলাশ ছবির ব্রেক পয়েন্ট। আর পথে ধারে অসংখ্য কুল গাছ। পাকা কুলে ভর্তি। আমরা এত কুল কুড়িয়েছি যে রাখার জায়গা পাচ্ছিনা।

 

 

গ্রামের লোকের সাথে কথা বলে, রাস্তা জেনে পৌঁছে গেলাম ডাউরি খাল। মার্চের একদম প্রথম, তাই নদীটা খুব শীর্ন। কিন্তু তাতেও তার কলকল শব্দে কথা বলা থেমে নেই। তাঁবু লাগিয়েই নেমে পড়লাম প্রাকৃতিক সুইমিং পুলে। ঠান্ডা মিষ্টি জল। একনিমেষে সারাদিন হাঁটার ক্লান্তি উধাও। সন্ধে নামল পাথরে ওপরে শুয়ে বসে আড্ডা দিয়ে। আজ পুর্নিমা, আকাশ জুড়ে চাঁদমামা হাজির হলেন। মুহুর্তে চারদিক পরিবর্তন হয়ে গেল। আমরা পৃথিবীর বাইরের এক জগতে চলে গেলাম। সেই সময়টুকুর জন্য ভুলে গেছিলাম সংসার সমাজ সবকিছু। সে এক অবাক করা অনুভূতি।

 

 

 

 

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল একটা অদ্ভুত ডাকে। বাইরে এসে দেখি সুপ্রভাত জানাচ্ছেন একটি গ্রে হর্নবিল।সামনের গাছের ডালে তার সাথে সঙ্গ দিচ্ছে প্লাম হেড প্যারাকিট যুগল। সকাল সকাল তাঁবুপত্র গুটিয়ে, কেক আর হরলিক্স দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে হাঁটা শুরু। ম্যাপ অনুযায়ী আজকের রাস্তা অনেক কম কিন্তু জঙ্গলের ঘনত্ব বেশি। আমাদের রাস্তার পূবে গোবারিয়ার বিখ্যাত জঙ্গল। শুনেছি ওখানে কিছু রেসিডেন্সিয়াল হাতি থাকে নাকি। রাস্তা ভুল করে ঢুকে পড়লে আজ আর কালকের মত ফিরে আসা যাবে না। তাই খুব সতর্ক হয়ে পথ চলছি। নদীর উজানে বেশ কিছুটা এসে নদীকে ডানদিকে রেখে অপর একটা গালি ঢুকলাম। সবসময় ম্যাপ আর কম্প্যাস হাতে। ঘন্টা খানেক হাঁটার পর একটা কাঠুরিয়াদের ট্রেল পাওয়া গেল। ওই ট্রেলটা যেহেতু আমাদের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে তাই ওটাই ধরলাম। ধীরে ধীরে একটা রিজ টপে উঠে এলাম। নিজে দেখতে পেলাম কুদনা গ্রাম। অনেক ট্রেল ডাইনে বায়ে নেমে গিয়েছে। বুঝলাম এদিকে কাঠুরিয়াদের অত্যাচার অনেক বেশি। এই জঙ্গল খুব বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। পথে দেখা পাওয়া কাঠুরিয়া বলেছিল এই রিজ টপের রাস্তাটাই আমাদের অযোধ্যা নিয়ে যাবে। তাই ডানে বামে না গিয়ে একমুখী হলাম। আরও ঘন্টা দুয়েক হেঁটে পৌঁছে গেলাম আপার ড্যাম। রাতটা কাটালাম আপার ড্যামের পাশের জঙ্গলে তাঁবু ফেলে। রাতেরবেলা ড্যামের অপার জলরাশির ওপর চাঁদের আলোর খেলা দেখতে দেখতে মনে আসছিলো আমাদের চিরনতুন কবির সেই লেখা...“আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।”

 

Let us know what you think

* Required field